বরাক উপত্যকার বর্ণময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
∞ তুষারকান্তি নাথ ∞
বরাক উপত্যকা একটি প্রাচীন জনপদ । প্রাক
স্বাধীনতা যুগের ‘সুরমা উপত্যকা’র খণ্ডিত পূর্বাংশ অর্থাৎ বর্তমান দক্ষিণ
আসামের তিনটি জেলা ( কাছাড়, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ ) –এর সাধারণ
অভিধা ‘বরাক উপত্যকা’ । এ অঞ্চলের
ভূ-গঠন
সম্পর্কে নিহাররঞ্জন রায় বলেছেন : ‘চট্টগ্রামের পার্বত্য-চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য- ত্রিপুরা অঞ্চল,
কাছাড় জেলার উত্তরাংশ ও দক্ষিণাংশে হলিয়াকান্দি
অঞ্চল, এবং
শ্রীহট্ট জেলার পূর্বাঞ্চলকে মোটামুটি পুরাভূমির অন্তর্গতই বলিতে হয় । … এইসব ভূখণ্ডে প্রাচীনকাল
হইতেই বহুদিনস্থিত সমৃদ্ধ সভ্যতা এবং জনবাসের দ্যোতক । এইসব ভূখণ্ড পুরাতন গঠন, এবং ইহাদের
অবলম্বন করিয়াই প্রাচীন বাঙলার সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্বাঞ্চলে বিস্তারলাভ করিয়াছিল
।‘ বস্তুত বরাক
উপত্যকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট , উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ দেখে
ধারণা করা যায় যে , প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই অঞ্চলটি মানুষের বসবাসের উপযোগী
ছিল । উত্তর কাছাড়ের ( ডিমা হাসাও ) হাফলং শহর সংলগ্ন
সরকারিবাগান , মুপা ও বরাইল পর্বতমালার অংশবিশেষ গুইলুং পাহাড়ে ঘন জঙ্গলে
ঢাকা পর্বতগুহায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষের জীবনযাত্রার কিছু চিত্ররূপ দেখা যায় ।
এছাড়া নব্যপ্রস্তরযুগের আয়ুধ, হাতিয়ার ও ব্যবহারিক
অন্যান্য নিদর্শন পাওয়া গেছে উত্তর কাছাড়ের ডাওজালিহাডিং, মেঘালয়ের গারোপাহাড় ও
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে । এই তিনটি স্থান সরলরেখা দিয়ে যোগ করলে যে ত্রিভুজ তৈরি হয়
বরাক উপত্যকা তার মধ্যেই পড়ে । কুমিল্লার লালমাইপাহাড়, সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার
চুনারুঘাট, মনিপুর এবং কাছাড়ের কনকপুর (৩য় খণ্ড ) গ্রামেও
নব্যপ্রস্তরযুগের আয়ুধ পাওয়া গেছে । এসব সাক্ষ্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী এবং
নিশ্চিতভাবে মনে করা যায় যে, সুজলা-সুফলা বরাক
উপত্যকায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষের উপস্থিতি ছিল । স্থায়ী বসতি স্থাপনের প্রবণতা
নব্যপ্রস্তরযুগেই বিশেষভাবে প্রকটিত হয় এবং এই যুগেই মানুষ পশুপালন ও কৃষির উপযোগী
স্থানে বসতি স্থাপন করত বলে পণ্ডিতেরা সহমত পোষণ করেন ।
প্রাচীন বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত ও প্রতিবেদন দেখা গেছে , খ্রিস্টপূর্ব
যুগেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের কয়েকটি পথ-উপপথ বরাক
উপত্যকাকে স্পর্শ করেছিল । তাই স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর অবাধ বিচরণ
তথা বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেনের একটি পরিবেশ
এখানে তৈরি হয়েছিল । গড়ে উথেছিল এক অসাধারণ সভ্যতা- সংস্কৃতি । মিলিত হয়েছে
সংস্কৃতির নানা ধারা-উপধারা । বস্তুত সুপ্রাচীনকাল থেকে বরাক উপত্যকা ও সন্নিহিত
এলাকায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাতে এ অঞ্চলের জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, বারিচরিত্র
ও অরণ্যপ্রকৃতি মানুষের জীবনচর্যা ও তার বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল ।
# # # #
২.
ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরপূর্বের মধ্যে
বৈচিত্র্যপূর্ণ এক মনোরম প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ বিরাজ করছে বরাক অববাহিকার
বুকে । বৈচিত্র্য রয়েছে এখানকার জনবসতির মধ্যেও । নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব তথা সামাজিক- সাংস্কৃতিক
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে উপমহাদেশের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল এই বরাক উপত্যকা ।
অসট্রিক- মঙ্গোলিয়-আলপীয় ইত্যাদি নৃ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে
পূর্বভারতে যেভাবে বাঙালি জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল, বরাক-সুরমা
উপত্যকায়ও তা একইভাবে হয়েছে । তবে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের মানুষের মধ্যে ইন্দ-মঙ্গলীয়
প্রভাব একটু বেশি পরিমাণেই রয়েছে । মঙ্গোলয়েড নৃ-গোষ্ঠীর বংশধারা বরাক
উপত্যকা তথা কাছাড়ের বিবর্তিত সমাজ-ব্যবস্থায় আজও যে প্রবহমান এ প্রসঙ্গে
ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘মঙ্গোলয়েড
জাতিই কাছাড়ের আদিম নরগোষ্ঠী, তার মানে এই নয় যে, এদের আগে
কোন নৃ-গোষ্ঠী
এখানে ছিল না । এখানে অসট্রিকরা পূর্বাবধিই ছিল, তাদের বিস্তৃতিও কিছু
কিছু ঘটেছিল, কিন্তু কোন অজানা কারণে অতি সামান্য চিহ্ন মাত্র রেখে তারা
এই অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল । এরূপ সময়েই এসেছে মঙ্গোলয়েডরা । অসট্রিকদের
সহিত এদের কোন সংঘর্ষ ঘটেনি, অন্তত: তেমন কোন চিহ্ন এখনও
আবিষ্কৃত হয়নি । তদবধি মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীই এখানে মূল নৃ- ধারারূপে বিরাজ করছে ।
এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, যশোনারায়াণ, মেঘনারায়ণ
যখন মাইবাং-এ এসেছিলেন, তার বহুপূর্ব থেকেই
ডিমাছা নরগোষ্ঠী কাছাড় ভূ-খণ্ডে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল । এখানে যে বিপুল
পরিমাণ তপশীলী জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক অনুন্নত শ্রেণীর সাক্ষাৎ মেলে
তাদের অধিকাংশই সদ্যনির্মোক-মুক্ত মঙ্গোলয়েড বা মিশ্র- লোক- উপজাতি।’ কাছাড়- সিলেট
সংলগ্ন খাসি ও জয়ন্তিয়াপাহাড়ে (মেঘালয়) অসট্রিকভাষী ( মোন্- খমের উপশাখা
) খাসি ও
জয়ন্তিয়াদের বসতির প্রাচিনত্ব সন্দেহাতীত । বরাক উপত্যকার সমতলের প্রত্যন্তে পাহাড়-টিলা- বনাঞ্চলে
খাসি- জয়ন্তিয়াদের
বসবাস এখনও লক্ষ্য করা যায় । ইন্দো-মঙ্গোলীয় বোড়োরাও (টিপরা ) সুপ্রাচীনকালে
সমতল কাছাড়ে বসতি বিস্তার করেছিল এবং এখানেই ত্রিপুরী রাজ্যগঠন প্রক্রিয়া শুরু
হয়েছিল । পরবর্তীকালে ইন্দো- মঙ্গোলীয় কোচ এবং
ডিমাছারাও এখানে রাজত্ব করেন । ‘বরাক’ নদী-নামটিই
টিপরা ( ত্রিপুরী ) ভাষার ‘বরক’ থেকে হয়েছে।
অন্যমতে ডিমাছা ভাষা-সজ্ঞাত--- ব্রা- বক্র > ব্রা-ক্র > ব্রাক > বরাক । বরাক
নদীর অপর নাম ‘কলংমা/ খলংমা’--- এই নামটি
অসট্রিক ভাষার শব্দ বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন । বস্তুত বরাক- সুরমা উপত্যকার আঞ্চলিক
ভাষা, লোকভাষা, লোকসংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস
এবং বহু নদীনাম ও স্থাননামে অসট্রিক ও মঙ্গোলীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।
#### #### ##### #### #####
৩.
বরাক উপত্যকায় বাঙালি, ডিমাছা, ত্রিপুরী ( টিপরা ) , কোচ-রাজবংশি ( ধেয়ান ) , খাশি, জয়ন্তিয়া
ছাড়াও জনসংখ্যার দিক দিয়ে দু’টি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মনিপুরি (মৈতৈ) ও রংমাই-নাগা বসবাস
করছেন । আরও আছেন কুকি, মার, লুসাই, রিয়াং, বিষ্ণুপ্রিয়া, নেপালি, চরই ইত্যাদি
। ব্রিটিশ রাজত্বকালে উপত্যকার পাহাড় ও
টিলাভূমিতে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা-বাগান গড়ে তোলা হয় । চা- বাগানের
শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়েছিল উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে, এমনকী দাক্ষিণাত্য থেকেও
। এই শ্রমিকদের মধ্যেও আছেন নানা ভাষিকগোষ্ঠীর মানুষ । বস্তুত, ইতিহাসের
বিভিন্ন পর্বে রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ইত্যাদি নানা কারণে বিভিন্ন নৃ- গোষ্ঠী ও
ভাষিকগোষ্ঠীর প্রব্রজন সুপ্রাচীনকাল ধরে ধীরে ধীরে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত হয়েছিল
। বিভিন্ন ভাষিকগোষ্ঠী তথা নৃ-গোষ্ঠীর
মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই উপত্যকা। এখানকার ধর্ম ও সংস্কৃতিতে সমন্বিত হয়েছে
বিচিত্র ও ভিন্নমুখী চিন্তা- চেতনা, আদর্শ- ভাবধারা ।
আমরা এখানে উপত্যকার প্রধান তিনটি গোষ্ঠীর
সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব । এই তিনটি গোষ্ঠী হল ডিমাছা, মনিপুরি ও
বাঙালি । তাতে দেখা যাবে পারস্পরিক যে-সাংস্কৃতিক লেনদেন , তা হয়েছে বহুমাত্রিক এবং
বহুপাক্ষিক ।
‘ শিব্রাই- গামাডি’ ( শিব- শক্তি) উপাসক ইন্দো- মঙ্গোলীয়
গোষ্ঠীভুক্ত ডিমাছা রাজাদের হেড়ম্ব রাজ্যের রাজধানী পার্বত্য এলাকার মাইবাঙে
থাকাকালেই বঙ্গীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির দারা প্রভাবিত হয়েছিল । মধ্যযুগে ডিমাছা রাজার
রাজদরবারকে বাংলা ভাষা- সাহিত্য চর্চার একটি কেন্দ্ররূপে পরিণত করেন । সমতলের
খাসপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত হবার পরও সেই ধারা অব্যাহত থাকে । হেড়ম্ব রাজদরবারে
রাজারা শুধু বাংলা ভাষা- সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাই করেননি, নিজেরাও বাংলা ভাষা- সাহিত্যচর্চা
করেছিলেন । রাজা সুরদর্পণনারায়ণ (খ্রি. ১৭০৮-১৭০২), রাজা রামচন্দ্রধজনারায়ণ (খ্রি. ১৭২৮-১৭৩৫) , রাজা
কৃষ্ণচন্দ্রনারায়ণ ( খ্রি. ১৭৮০- ১৮১৩) শাক্তপদ
রচনা করেছিলেন । ডিমাছা রাজপরিবারের
অধিষ্ঠাত্রী দেবি ‘রণচণ্ডী’ আরযীকরণের মাধ্যমে এই
সময়েই হেড়ম্ব রাজ্যে সমন্বয়ের দেবীতে পরিণত হয়েছিলেন । রাজা গোবিন্দচন্দ্রনারায়ণ (খ্রি. ১৮১৩-১৮৩০ ) বঙ্গীয়
ঐতিহ্যে তাঁর ‘গোবিন্দকীর্তন’ ও ‘মহারাসোৎসব গীতিমালা’ রচনা
করেছিলেন । ‘গোবিন্দকীর্তন’ কীর্তনগানের সংকলন আর ‘মহারাসোৎসব
গীতিমালা’ শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলার গান । এদিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রনারায়ণ
মনিপুররাজ মধুচন্দ্রের কন্যা ইন্দুপ্রভাবকে বিয়ে করেন । এর ফলে হেড়ম্ব ও মনিপুর
রাজ্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নিবিড় হয়ে ওঠে । আবার এই সূত্রেই কাছাড়ে মনিপুরি
প্রাধান্যও প্রতিষ্ঠিত হয় । এখানে মনিপুরিদের বসতি স্থাপনের ফলেই হেড়ম্ব রাজ্যে
রাসলীলা ক্রমশ অত্যাদ্রিত হয়ে ওঠে । কৃষ্ণচন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর
গোবিন্দচন্দ্রনারায়ণ ইন্দুপ্রভাকে বিয়ে করেন । রাসলীলাকে অধিকতর জনপ্রিয় করে তোলার
উদ্দেশ্য নিয়েই রাজা গোবিন্দ্রচন্দ্রনারায়ণ বাংলা ভাষায় ‘মহারাসোৎসব গীতিমালা’ রচনা
করেছিলেন । রাসনৃত্য আবার মনিপুরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অন্যতম উপাদান ।
বস্তুত কৃষ্ণলীলা আখ্যান বহু বিচিত্ররূপ মধ্যযুগের বরাক উপত্যকার লোকমানসকে
উদ্দীপিত করেছিল । ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় চৈতন্যদেব যে ভক্তিরসের বন্যা এনে
দিয়েছিলেন তাঁর প্রভাব সিলেট-কাছাড়েও পড়েছিল । এই সূত্রেই হেড়ম্ব ও মণিপুর
রাজপরিবারে বৈষ্ণব প্রভাব একটি অন্যমাত্রা এনে দেয় ।
মণিপুরি ভাষা ভোটবর্মী (Tibeto-Burman) ভাষা- বর্গের
অন্তর্গত কুকি-চিন শাখার মধ্যেই পড়ে ।দৈহিক আকৃতির দিক দিয়ে মণিপুরিরা
মঙ্গোলীয় আকৃতির । সপ্তদশ শতকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের আদি- ধর্মাচার ( প্রাক- হিন্দু) এখনও
সমান্তরালভাবে প্রবহমান । চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম- সংস্কৃতি
শান্তদাস গোস্বামীর হাত ধরে মণিপুর রাজপরিবার ও মণিপুরি সমাজে পৌঁছায় এবং এই
সূত্রেই মণিপুরিদের ধর্মকর্ম-মূল্যবোধ, সাহিত্য-সঙ্গীতের
কেন্দ্রে ‘পানথৈবি’র পাশাপাশি রাধিকার প্রাধান্যও একটি লক্ষণীয়
দিক হয়ে ওঠে । গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম- সংস্কৃতি মণিপুরি সমাজে
সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে । অবশ্য আদান-প্রদান চলছিল উভয় দিক
দিয়েই । মণিপুর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তো বটেই, কাছাড়ের বাঙালিদের সংস্কৃতির
অঙ্গনেও দিয়েছে অনেক কিছু । বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত কাছাড়ের অনেক বাঙালিই
মণিপুরে গিয়ে মৃদঙ্গ বাদনের তালিম নিয়ে আসতেন, রাধাকৃষ্ণ- লীলা বিষয়ক
পদ- সঙ্গীতের
মণিপুরি- কীর্তনশৈলী তালিম নিয়ে আসতেন । এভাবে যারা তালিম নিয়ে আসতেন
কাছাড়ে তাঁদের বলা হত ‘ওঝা’ । কাছাড়ের
বিভিন্ন এলাকার বাঙালির শ্রাদ্ধবাসরে মণিপুরি শৈলীর কীর্তন গানের আয়োজন করার একটা
রেওয়াজ ছিল, যা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে ।
#### ## ####
৪.
বস্তুত , সংস্কৃতি তো শুধুমাত্র
শিল্প- সাহিত্য- দর্শনের
চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তা মূলত জীবনযাত্রার
বিন্যাসের সঙ্গেও জড়িত । বরাক উপত্যকার বাঙালির জীবনচর্যায় মঙ্গোলীয় প্রভাব
নানাভাবেই সুপরিস্ফুট । অন্যদিকে, পাশাপাশি বসবাসের ফলে
মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীও বাঙালি- সংস্কৃতি দ্বারা
অনেকখানি প্রভাবিত । এরকম কিছু উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে । দেশাচার
হেতু বরাক উপত্যকার অনেক মণিপুরি সধবা মহিলাকে বাঙালি ত্রয়োস্ত্রীর মতো শাঁখা-সিঁদুর
ব্যবহার করতে দেখা যায় ।
ডিমাছা মহিলাদের ক্ষেত্রেও তা-ই । মণিপুরি
মেয়েদের খোঁপা বাঁধার শৈলী উত্তরপূর্ব ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর নন্দিনীদেরও
প্রলুব্ধ করে । ডিমাছা মেয়েদের খোঁপা বাঁধার নানারকম শৈলীর সঙ্গে সর্বভারতীয় শৈলীর
সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেলেও তাদের একটি শৈলী বা প্রকরণের নাম ‘জেম- মগলাই’ অর্থাৎ
মণিপুরি খোঁপা । ঘরোয়া কাজকর্মে ও কৃষিকর্মে উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন উপজাতির
কাছে গামছা এখনও সমান প্রিয় এবং সহজ স্বাচ্ছন্দপূর্ণ পরিচ্ছদরূপে রঙিন গামছা
সর্বজন স্বীকৃত । মণিপুরিদের মধ্যেও গামছার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করার মতো । বরাক
উপত্যকার বাঙালি সমাজে মণিপুরি-গামছার কদর অত্যন্ত বেশি । বাঙালি সমাজে
মণিপুরি –গামছা উপহার স্বরূপ কারও হাতে তুলে দেওয়া সামাজিক শিষ্টাচার
তথা সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয় । মণিপুরি মহিলা ও যুবতীদের কবরী বন্ধনে
ফুলসাজের প্রচলন আছে । কবরী অলঙ্করনে চাঁপা ফুলের ব্যবহারই বেশি । তাও সম্ভবত
বৈষ্ণব পদাবলীর সূত্রে । বৈষ্ণব পদে আছে --- ‘চূড়া ছাঁদে বাঁধা চুল, তাহাতে
চাঁপা ফুল’।
পান- আহারের রীতি, রুচি এবং
রন্ধনকলার বৈচিত্র ও বৈশিষ্টের মধ্যে বিশ্বের যে কোনও অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক
মূল্যমানের পরিচয় পাওয়া যায় । বরাক উপত্যকার বাঙালি হিন্দু- মুসলমানদের ‘চোঙ্গা- পিঠা’- সংস্কৃতি এ
প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য । বাঁশের চোঙ্গায় আঠাযুক্ত ‘বিরুন’ ( বিন্নি ) ধানের চাল ও
জল ঢুকিয়ে সেদ্ধ করে ‘চোঙ্গা- পিঠা’ তৈরি করার
পদ্ধতি এবং এই খাদ্যাভ্যাসটি এ অঞ্চলের বাঙালির পূর্বপুরুষ অসট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো- অসট্রোলয়েড ) ও মঙ্গোলীয়
সংস্কৃতির অবদান বলেই মনে হয় । শুধু চোঙ্গা- পিঠা নয়, বর্ষা
মরসুমে বাঁশের কোমল কোঁড় এবং শুটকি মাছ বাঁশের চোঙ্গায় ঢুকিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি
‘চোঙ্গা- সিদল’ মণিপুরি- ডিমাছার মতো
এখানকার বাঙালিরও প্রিয় খাদ্যবস্তু । ডিমাছাদের প্রাত্যহিক জীবনধারায় ‘ জুডি’ ( ঘরে তৈরি
একধরনের মদ )- এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । লোকদেবতাদের
পূজা-অর্চনায়, অতিথি
আপ্যায়নে, সামাজিক উৎসব-পার্বণে,পারিবারিক অনুষ্ঠানে ‘জুডি’ অপরিহার্য ।
কারও কারও মতে ‘জুডি’ শরীর ও স্বাস্থের পক্ষে
যথেষ্ট উপকারী পানীয় ।সন্তান প্রসবের পর ডিমাছা প্রসূতিদের গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে
নিয়মিত ‘ জুডি’ পান করতে দেওয়া হয় ।
অনুপান হিসেবে ব্যবহার করলে প্রসূতি দ্রুত সতেজ-সবল হয়ে ওঠে এবং তা
স্তন্যবর্ধক বলেও অনেকের ধারণা । এই মত ও ধারণা থেকে ডিমাছা অধ্যুষিত এলাকার
বাঙালিরাও ‘জুডি’-র প্রতি আকর্ষণ অনুভব
করে । বরাক উপত্যকা তথা সংলগ্ন অঞ্চলের ডিমাছা-মণিপুরির মতো এখানকার
বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের কাছেও পান-সুপুরি ঐতিহ্য-সংস্কৃতির
প্রতীক ।অতিথি অভ্যর্থনা , অথিতি আপ্যায়নের পর, বিবাহের
লোকাচার, পারিবারিক উৎসব-অনুষ্ঠানে ডিমাছা-মণিপুরির মতো এখানকার
বাঙালি সমাজে পান- সুপুরি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, অন্য
অঞ্চলের বাঙালি সমাজে এর প্রভাব সামান্যই ।
একই আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এবং একই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সুদীর্ঘকাল
ধরে বসবাস করার ফলেবরাক উপত্যকার উপজাতি ও অউপজাতির লোকায়ত জীবনবৃত্তে সাংস্কৃতিক
মিলন-মিশ্রণ
প্রচুর পরিমাণে ঘটে চলেছে এবং সমন্বিত সংস্কৃতিই এখানকার মানুষের জীবনচর্যাকে
বর্ণময় করে রেখেছে ।
তথ্য নির্দেশ :-
১) নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর
ইতিহাস, কলকাতা, ১৪০০, পৃ.১০৩
২) ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায়, কাছাড়ের
জনবিন্যাস, শিলচর, ১৯৮৮,পৃ.১৮-১৯ ।
No comments:
Post a Comment